Hits: 39
পাঠক মিত্র
গান্ধীজীর সম্পর্কে একটি বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে আরএসএস প্রধান বলেছিলেন, গান্ধী দেশপ্রেমিক হিন্দু বলেই। এ কথা বলতে গিয়ে গান্ধীজীর একটি কথার অংশ উল্লেখ করেছেন। গান্ধীজী বলেছেন, ভারতের প্রতি আমার ভালোবাসা যা ধর্ম থেকেই পাওয়া। গান্ধীজীর এ কথা ধরেই ভাগবতজি বলেছেন, ‘গান্ধী মনে করতেন ধর্ম থেকেই দেশপ্রেমের জন্ম। ধর্ম মানে শুধু ধর্ম নয়, তার থেকেও বেশি।’ এই ‘বেশি’র অর্থ যে তাঁদের কাছে কোন অর্থ বহন করে আজকে অনেক ক্ষেত্রেই তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এখন সে কথার আলোচনা ব্যতি রেখে বলা যায় যে ‘ধর্ম’ আর ‘দেশপ্রেম’ শব্দদুটি তাঁরা তাঁদের ইতিহাসে সমার্থক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।
‘দেশপ্রেম’ শব্দটি স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত অথচ মোহন ভাগবতের আরএসএস র পূর্বসূরিরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশপ্রেমিক হিসেবে যে চোখে দেখতে চেয়েছেন সেখানে গান্ধীজী র স্থান ছিল না। তাঁদের চোখে দেশভক্ত বা দেশপ্রেমিক কারা ছিলেন। তাঁরা প্রতিটি হিন্দুকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁদের এই জাতীয়তাবোধে দেশভক্ত কারা তা বলেছেন তদানীন্তন সঙ্ঘের গুরুজি গোলওয়ালকর তাঁর ‘বাঞ্চ অব থট্স’-এ, ‘ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ এবং সার্বজনীন বিপদের তত্ত্ব থেকে আমাদের জাতিত্বের ধারণা তৈরি হয়েছে। এর ফলে আমাদের প্রকৃত হিন্দু জাতিতত্বের সদর্থক অনুপ্রেরণা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। স্বাধীনতা আন্দোলনকে কার্যত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত করা হয়েছে, … ব্রিটিশ বিরোধিতার সঙ্গে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকে সমার্থক করে দেখা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, তার নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের ওপরে এই প্রতিক্রিয়াশীল মতের প্রভাব সর্বনাশা হয়েছে। …তারাই একমাত্র জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক, যারা তাদের অন্তরে হিন্দু জাতির গৌরব পোষণ করে এবং সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করে। বাকি যারা দেশপ্রেম জাহির করে হিন্দুজাতির স্বার্থহানি করছে তারা বিশ্বাসঘাতক ও দেশের শত্রু। ‘ গুরুজি আরো বলেছেন, ‘যারা বলেছিল হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ছাড়া স্বরাজ সম্ভব নয়, তারা আমাদের সমাজের সাথে সব থেকে বেশি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ‘ গান্ধীজী বলেছিলেন যে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ছাড়া স্বরাজ সম্ভব নয়। তাহলে গুরুজির কথা থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে সঙ্ঘ কতটা স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে আর কতটা গান্ধীজীর পক্ষে। এখন আবার গান্ধীজীর হত্যাকারীকে আজকে দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখছেন তাঁদেরই কোনো না কোনো মানুষজন। তাহলে গান্ধীজী র হত্যার সমর্থনে তাঁদের ইতিহাস না থাকলে হত্যাকারী দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতে পারে না।
যদিও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গান্ধী হত্যা সম্পর্কে আরএসএস কোনোভাবেই দোষী নয় বলে তার প্রমাণ মাননীয় আদালতে হয়েছে। এমনকি গান্ধী হত্যার জন্য কোনো প্ররোচনামূলক বক্তব্যও সঙ্ঘ তখন করেনি। তবে গান্ধী হত্যার দু’মাস আগে গোলওয়ালকর এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘ গান্ধী এদেশে মুসলমানদের রাখতে চেয়েছিলেন কারণ তাহলে কংগ্রেস মুসলমানদের ভোট পেয়ে জিততে পারে। কিন্তু ভোটের সময় আসা পর্যন্ত এ দেশে একজনও মুসলমান পড়ে থাকবে না। যদি তাদের জোর করে এখানে রাখা হয়, তার দায়িত্ব সরকারের। হিন্দু সমাজের কোনো দায় নেই। গান্ধী আরএসএস কে আর ভুল পথে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। ‘ এই বক্তব্যের শেষে আরো বলেন, ‘ এরকম লোকেদের চুপ করানোর অনেক উপায় আমাদের আছে। কিন্তু এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া, যার দ্বারা হিন্দু সমাজের ক্ষতি হতে পারে, আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে পড়েনা। কিন্তু আমাদের যদি জোর করা হয় আমরা সেই পথ নিতে পিছপা হব না। ‘ তারপর গান্ধী নিহত হয়েছিলেন। আর হত্যাকারী আরএসএস সদস্য যে নয় তার প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু গান্ধী হত্যা মামলায় হত্যাকারী নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে যাঁর নাম প্রাথমিকভাবে জড়িয়েছিল, তাঁর এক বক্তব্য এখানে বললে আরো পরিষ্কার হবে। তিনি বলেন, ‘ নাথুরাম, দত্তাত্রেয়, আমি ও গোবিন্দ। আমরা সব ভাইয়েরাই আরএসএস র সদস্য ছিলাম। আমরা নিজেদের বাড়িতে যত না বড় হয়েছি তার থেকে বেশি পালিত হয়েছি আরএসএস শাখায়। আরএসএস আমাদের কাছে পরিবারের মতন ছিল। নাথুরাম বৌদ্ধিক কার্যবহ ছিল। ও জবানবন্দিতে বলেছিল ঠিকই যে ও আরএসএস ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার কারণ এটাই যে গান্ধী হত্যার পরে আরএসএস ও গোলওয়ালকর অনেক সমস্যায় পড়েছিলেন। এর অর্থ এই নয় যে ও সত্যি সত্যি আরএসএস ছেড়েছিল। ‘
তাহলে আরএসএস প্রধানেরও গান্ধীস্তুতি আর তাঁর সংগঠনের ইতিহাস এক নয়। গান্ধীজীকে হত্যা করার জন্য হিন্দুত্ববাদীদের চেষ্টা সফল হয়েছিল শেষে। গান্ধীজী আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার খবরে বলা হয়েছিল যে আততায়ী একজন হিন্দু। আর আততায়ী যে ‘হিন্দু’ তা এই খবরে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ বহন করেছে। এই হিন্দু আততায়ী যে গান্ধীজীর প্রাণ নিতে পারে তার পূর্বাভাস আগেই ছিল। গান্ধীজীর মৃত্যুর সংবাদে তদানীন্তন উপপ্রধানমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল বলেছিলেন, ‘….যেমনভাবে তাঁর ইতি ঘটল, তার জন্য আমাদের লজ্জা আর যন্ত্রণার শেষ নেই। গত সপ্তাহেও এক হিন্দু যুবক তাঁকে বোমা নিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করেছিল, তখন তিনি কোনোভাবে রক্ষা পেয়েছেন। ‘
তাহলে আরএসএস প্রধানের ‘ধর্ম’ আর ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে গান্ধীস্তুতি ইতিহাসকে ঢাকা দিতে পারে না।