Hits: 6
বটুকৃষ্ণ হালদার
বিগত দেড় বছর যাবৎ সমগ্র মানব সভ্যতা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। অতিমারি করোনার প্রথমত ও দ্বিতীয় স্টেজ পার করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। তাও পুরোপুরি বিপদমুক্ত বলা যায় না। এমত অবস্থায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তৃতীয় ধাপের সর্তকতা জারি করেছে। তবুও এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। এমন এক বিধ্বংসী সময়েও মানুষের জীবনের কথা চিন্তা না করে দেশের একশ্রেণীর ক্রীড়াজীবীমহল, জাপানের টোকিওতে রিও অলিম্পিকে আসর বসার দিনক্ষণের নির্ঘণ্টও বাজিয়ে দেয়। ১৩০ কোটির দেশ ভারতবর্ষ এই অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বের জনসংখ্যার নিরিখে ভারতবর্ষের স্থান চিনের পরে। চিন যেখানে পদক তালিকায় দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে ভারত সেদিক থেকে তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করেছে। হাতেগোনা পাঁচ-ছয়টি পদক পেয়েছেন ভারত। তারমধ্যে জ্যাভলিন থ্রোতে নীরাজ চোপড়া পায় একটিমাত্র সোনা। আর তাতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছে সমগ্র দেশ। একটিমাত্র সোনা জয়ের আনন্দে চারিদিকে উৎসব পালিত হচ্ছে। এত বড় এক দেশে একটি মাত্র সোনা এই খবরটা সত্যি কি আনন্দের না লজ্জার? গর্ব করে বলার মতো কিছু আছে কি? অথচ দেখুন ইউরোপের একটি দেশ যার নাম সান মারিনো, যার জনসংখ্যা পঞ্চাশ হাজারও নয়। ৩৪ হাজারের দেশ সর্বপ্রথম রিও অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে একটি ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। যাইহোক ভারতবর্ষ অলিম্পিক খেলার জন্য মোটেই উপযুক্ত নয় সে বিষয়টা কিন্তু পরিষ্কার।
তবে রিও অলিম্পিকে পদক পাওয়ার যে খরা তা মিটিয়ে দিয়েছে প্যারা অলিম্পিকে প্রাপ্ত স্বর্ণপদক। দেশের সুস্থ-সবল খেলোয়াড়রা পদক পাওয়ার জন্য উপযুক্ত বলে প্রমাণ দিতে পারেনি, শরীর থেকে দেশের প্রতিবন্ধী খেলোয়াররা একের পর এক সোনা জয় করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে ফেলেছে বিশ্বের দরবারে। টোকিও প্যারা অলিম্পিক ২০২০ ভারত ফিরছে ১৯টি পদক নিয়ে। এটাই এখনও পর্যন্ত প্যারা অলিম্পিকের ইতিহাসে ভারতের সেরা প্রদর্শন। এর মধ্যে রয়েছে ৫ টি সোনা, ৮টি রূপো এবং ৬টি ব্রোঞ্জ। সেই সঙ্গেই ভারত প্রথম ২৫-এর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। ভারতের পদক তালিকা ক্রম সংখ্যা ১৯। এটাও যে কোনও বহু দেশীয় প্রতিযোগিতায় ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রদর্শন। তবে বিশ্বের দরবারে প্রমাণ হলো ভারতবর্ষ সুস্থ-সবল দেশ নয়। তবে রিও অলিম্পিকের লজ্জা ঢেকেছে প্যারা অলিম্পিকে প্রাপ্ত পদকগুলো।
তবে দোষ শুধুমাত্র ওদের নয়। কারণ আমাদের দেশে বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে আইনমন্ত্রী আইন জানেন না, অর্থমন্ত্রী অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেনি, শিক্ষামন্ত্রী উচ্চমাধ্যমিক পাশ, আবার ক্রীড়ামহলে বহু পদাধিকার কর্মকর্তা বসে আছেন যিনি আন্তর্জাতিক স্তরে কোনও খেলা খেলেনি। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দেশের অনেক উচ্চপদে বসে আছেন যিনি হয়তো পড়াশোনা জানেন না। আমাদের দেশে রাজনীতিতে পড়াশোনা না জানলেও তার কদর করা হয়, যিনি বন্দুক চালাতে পারেন, বোমাবাজি, মস্তানি করতে পারেন। দেশের ক্রীড়া বিভাগের পরিকাঠামো যেমন অনুন্নত, তেমনি রয়েছে দৃঢ় মানসিকতার অভাব। আমরা কখনই জানতে চাইনি, দেশের ক্রীড়া বিভাগের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় সেই অর্থ কোথায় যায়? এই প্রশ্ন কি আমাদের মনে জাগে না কখনই যে স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত তবুও ক্রীড়া বিভাগের পরিকাঠামো এত নড়বড়ে কেন? আমাদের দেশে শুধুমাত্র অর্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অর্থ না থাকলে গুণসম্পন্ন প্রতিভাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়। বর্তমানে আমাদের দেশের নেতা-মন্ত্রীদের চিন্তাধারা হল ভাঁড় মে যায় দেশ, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। বেশিরভাগ নেতা-মন্ত্রী উন্নয়নের টাকায় দেদার ফুর্তি উৎসব পালন করে। দেশের পরিকাঠামোর উন্নতির কথা ভাবার সময় তাদের নেই। এসব তো লুকোচুরি বা মিথ্যা কোনও ব্যাপার নয়। যা কিছু ঘটছে সব আমাদের চোখের সামনেই। আমাদের দেশে প্রতিবাদের ভাষাও বিক্রি হয়ে যায়। যদিওবা প্রতিবাদ করেন তাহলে আপনাকে দেশবিরোধী, সন্ত্রাসবাদী বা মাওবাদী বলে জেলে ঢুকিয়ে দেবে।
সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘আমার অভিধানে না বলে কোন শব্দ নেই’। কারণ এই বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে সব মানুষের দ্বারা। আবার প্রতিবন্ধকতা কোনও সাফল্যের বাধা সৃষ্টি হতে পারে না তার নজির আমরা পাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে। মনে পড়ে মাসুদুর রহমানের কথা। একজন বাঙালি বিশ্ববিখ্যাত সাঁতারু। ১০ বছর বয়সে একটা রেল দুর্ঘটনায় হাঁটুর নিচে থেকে দুটি পা বাদ যায় তবুও যিনি বিশ্বের প্রথম প্রতিবন্ধী সাঁতারু হিসেবে জিব্রাল্টার প্রণালী সাঁতার কেটে পার হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে প্রতিবন্ধীরা আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে চলেছে। প্রতিবন্ধীরা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে ইচ্ছাশক্তির জোরেই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কিন্তু আমাদের সমাজে এমনও দেখা গেছে সুস্থ-সবল ব্যক্তি মানসিকতার কাছে হার মেনে সুসাইড করে। প্যারা অলিম্পিকে পদকজয়ীদের দেখে আমাদের সমাজের শিক্ষা নেওয়া উচিত। দেশের উন্নয়নের কান্ডারীদেরও উৎসাহ দিতে এগিয়ে আসতে হবে। ক্রীড়া বিভাগের পরিকাঠামোকে দ্রুত উন্নত করার চেষ্টা করতে হবে। তাতেই আরও উন্নতশীল হবে দেশ।