Hits: 441
বটুকৃষ্ণ হালদার
গত একবছর যাবৎ অতিমারী করোনা আবহে বিধ্বস্ত মানব সভ্যতা। কার্যত এই অতিমারী বিশ্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই একবছর আমরা ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। যা কল্পনা করিনি তাই দেখতে হলো। বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশ মৃত্যুর মিছিলে হেঁটেছে। লাশ সৎকার করার মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। কোথাও বা গণচিতা, কবর দেওয়া হয়েছে। কর্ম হারিয়েছেন লক্ষ লক্ষ জনগণ। বিশ্বের বৈজ্ঞানিকরা দিনরাত এক করে এর থেকে মুক্তির উপায় বের করতে অবশেষে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। কিন্তু জনগণ নিজেদের ভুলে দ্বিতীয় ঢেউ জনসমুদ্রে আঁ ছড়ে পড়ে। দেখা দেয় অক্সিজেনের অভাব। প্রাকৃতিক পরিবেশে যে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল অঢেল, জনগণের ভুলে সেই অক্সিজেনের অভাবে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে গেলো। ইতিমধ্যে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য সতর্কবার্তা আগাম দিয়েছেন। এসব কিছুকে উপেক্ষা করে শুরু হয়েছে অলিম্পিক। কিন্তু প্রশ্ন বর্তমান পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য রেখে অলিম্পিক খেলা কি বন্ধ রাখা যেত না?এক-দু বছর অলিম্পিক খেলা না হলে কি খুব ক্ষতি হতো। আমাদের মনে রাখা দরকার যে অতিমারির প্রথম ধাপ যতটা ছিল তার দ্বিগুণ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে দ্বিতীয় ধাপ। তাতে পশ্চিমবাংলা করোনার ভয়াবহ বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে। এর কারণ হলো বিধানসভা ভোট। বিশ্ব তথা ভারতবর্ষ থেকে করোনা তখনও ফুসছে এই কথা দেশের লাগামধারী ও বিশেষজ্ঞরা জানতেন। তবুও নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতালাভের বাসনায় দেশের মানুষদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন একশ্রেণীর মুখোধধারী যারা নিজেদের দেশের সেবক হিসাবে মনে করেন। ভোটের জন্য মিটিং-মিছিলের সমাগম আজ ভারতের ভবিষ্যতের দিকে আঙুল তুলছে। তাই এই পরিস্থিতিতে কাদের স্বার্থে খেলোয়াড়দের জীবন নিয়ে খেলা করা হচ্ছে? আর কখনওই মানুষের জীবনের আগে অলিম্পিকের মতো খেলাধুলো হতে পারে না, এটা বোঝা দরকার।
এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করেও জাপানে রিও অলিম্পিকের আসর বসে গেছে। তা নিয়ে মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সুখবর হলো ইউরোপের ছোট্ট একটা দেশ সান মারিনো বর্তমানে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে নাম লিখলেন। দেশের আয়তন মাত্র ২৪ স্কোয়ারে মাইলস। জনসংখ্যা ৫০ হাজার নয় খুব বেশি হলে ৩৪ হাজার হবে। সেই দেশ থেকে অলিম্পিকসে অংশ নিতে এসেছেন পাঁচজন অ্যাথলিট। এর মধ্যেই ইতিহাস গড়ে ফেললেন শুটার আলে সান্দ্রা পেরিলি। মহিলাদের শুটিংয়ে ট্র্যাপ ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতে সানমারিনোকে বিশ্বের দরবারে গর্বিত করেছেন। সমগ্র দেশ এই সাফল্যে উচ্ছ্বাসে ভাসছে। এদিকে বিশ্বের অন্যতম জনসংখ্যাবহুল দেশ ভারতবর্ষ এই অলিম্পিকে চার-পাঁচটা পদক জিতে পদক তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করেছে। ইতিমধ্যেই টোকিও অলিম্পিকসে ৪১ বছর পর হকিতে ব্রোঞ্জ জিতে আসার পর শুভেচ্ছায় ভাসল হকি দল। সমগ্র দেশ উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে। অলিম্পিকের মতো জায়গায় কোন পদক নিঃসন্দেহে দেশের পক্ষে গৌরব, কিন্তু উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ার মতো কোনও খবর আছে বলে তো মনে হয় না। ভারতবর্ষের জনসংখ্যার নিরিখে পদক তালিকার শীর্ষে হওয়া উচিত ছিল। বিশ্বের অন্যান্য ক্ষুদ্র বহু দেশ ইতিমধ্যেই টোকিও অলিম্পিকে সোনাজয়ী করে রেকর্ড গড়েছেন। অথচ ভারতের মতো এতো জনবহুল দেশে এখনও পর্যন্ত একটি সোনার মুখ দেখেছে। এই খবরটা কি সত্যি কোনও গৌরবের? বিশ্বের প্রথম জনসংখ্যাবহুল দেশ চিন। বিশ্বের যে কোনও ধরনের অলিম্পিক খেলায় পদক তালিকার শীর্ষে অবস্থান করে।
বিশ্বের অলিম্পিক খেলাগুলোতে ভারতবর্ষ পদকতালিকা সর্বনিম্ন অবস্থানের কয়েকটা কারণ বিশেষভাবে উল্লেখ না করলেই নয়। কারণ আমাদের ভারতবর্ষে উদীয়মান প্রতিভাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়। যার টাকা আছে তার প্রতিভা না থাকলেও তাকে সুযোগ করে দেওয়া হয়। মোদ্দাকথা এই ভারতবর্ষে টাকাপয়সাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমাদের দেশের কান্ডারীরা নিজেরা ভালো থাকার জন্য দেশকে রসাতলে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করেন না। এ প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট ঘটনা উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। ১৯৪৮ সালে ভারতীয় ফুটবল দল লন্ডন অলিম্পিকে সুযোগ পান। স্বাধীন ভারতের সে সময় ফুটবল টিমের জন্য জুতো কেনার পয়সা ছিল না। সেই অলিম্পিকে কিছু ভারতীয় খেলোয়াড় মজা আর বাকিরা খালি পায়ে খেলেছিল। ভারতের প্রথম ম্যাচ ফ্রান্সের সাথে ছিল। তাদের ফুটবলাররা কেউ খালি পায়ে খেলেনি। ভারতীয় টিমের প্রদর্শনের খুশি হয়ে দর্শকরা স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৫০ সালে ব্রাজিলের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের জন্য ভারত কোয়ালিফাই করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভারতীয় টিমকে ব্রাজিল পাঠাতে অনুমতি দেওয়া হয়নি সরকারের তরফ থেকে। সরকার পক্ষ থেকে দেশের মানুষকে বলা হয়েছিল ফিফা খালি পায়ে খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা লাগিয়েছে। আর ফিফাকে বলা হয়েছিল ভারতবর্ষে তাই ব্রাজিল পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আমাদের কাছে নেই। ফিফা জানিয়েছিলেন যে তারা চায় ভারতের মতো প্রতিভাবান টিম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করুক। তাই তারা ভারতীয় টিমের আসা-যাওয়া আর থাকা খাওয়া সব খরচ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তবুও সরকার অনুমতি দেয়নি। এরপর থেকে আজও ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপে ভারতের অংশগ্রহণ দিবাস্বপ্ন হয়ে থেকে যায়। এই দুই সময়ে ভারতে কংগ্রেস সরকার ছিল। অথচ দেশ স্বাধীনের সময় মহাত্মা গান্ধী অনশন করে পাকিস্তানকে ৫৬ হাজার কোটি টাকা পাইয়ে দেয়। যে সময়ে ভারতীয় ফুটবলাররা অলিম্পিকে খালি পায়ে খেলেছিল সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর দৈনিক পরিধান প্যারিস থেকে ড্রাই ক্লিন হয়ে আসতো। নেহেরুর প্রেমিকাকে লেখা চিঠি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে করে যেত। অথচ ভারতবর্ষের ক্রীড়া বিভাগের জন্য সেসময় নাকি পয়সা ছিল না। তবে সময় পরিবর্তন হয়েছে ইতোমধ্যে বহু সরকার রাজত্ব করে গেছে। এ অবস্থায় আজও উন্নতি হয়নি। ক্রীড়া বিভাগের পরিকাঠামো উন্নতির কথা কেউ ভাবে না। অথচ দেশে নেতা-মন্ত্রীদের বৈদেশিক ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত রাখা আছে। দেশে ও বিদেশে বিলাসবহুল গাড়ি বাড়ি আছে। দেশের জনগণের টাকায় নেতা-মন্ত্রী ও তাদের পরিবার বিদেশে পাড়ি জমায়। শুধু তাই নয় যে দেশে আইনমন্ত্রী দেশের সংবিধান জানেন না। উচ্চমাধ্যমিক পাশ শিক্ষামন্ত্রী হয়ে বসে থাকেন। জীবনে কোনদিন কোন খেলেনি অথচ দেশের ক্রীড়া বিভাগে পদাধিকারী হয়ে বসে রয়েছেন। সেই দেশে শুধু ক্রীড়া বিভাগ কেন সমস্ত ক্ষেত্রে নিম্নস্তরে অবতরণ করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।